সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯:২১ অপরাহ্ন
বগুড়া প্রতিনিধি, কালের খবর :
বগুড়ার ১২ উপজেলায় নিয়মিতভাবে বসা জুয়ার আসর নিয়ন্ত্রণ করে থানার পুলিশ। প্রতি রাতে ২০ থেকে ৪০ হাজার টাকা ঘুষ নেয়।
যার ভাগ পান সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি, সার্কেল) থেকে থানার দায়িত্বে থাকা পরিদর্শক ও অন্য সদস্যরা। তিন মাস ধরে কালের খবর ‘র অনুসন্ধানে মিলেছে এসব তথ্য।
গত ১ মে বিডি পুলিশ হেল্পলাইনে শিবগঞ্জ উপজেলার মোকামতলার এক বাসিন্দা পুলিশ সুপারকে (এসপি) উদ্দেশ্য করে অভিযোগ করেন, ‘জুয়ায় ভাসছে মোকামতলা। রাতের আঁধারে খেলা চলছে গ্রামে বাড়ির ভেতরে। লাখ লাখ টাকার জুয়া চলে। মোকামতলা পুলিশ তদন্তকেন্দ্রের পরিদর্শকসহ অন্য কর্মকর্তারা সবই জানেন। তাঁদের কাছে অভিযোগ করে কোনো লাভ নেই। আপনার সরাসরি হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। ’ উত্তরে শিবগঞ্জ-সোনাতলা সার্কেলের এএসপি মশিউর রহমান অভিযোগকারীর কাছে জুয়াড়িদের ঠিকানা জানতে চান।
কিন্তু পরবর্তী তিন দিনেও কোনো ব্যবস্থা নেননি।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, মোকামতলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবনের পেছনে বসে আসর। মোকামতলা শ্রমিক পরিবহন কার্যালয়ের ভেতরে প্রতিদিন আসর বসে। পাশের মোকামতলা পুলিশ ফাঁড়ির কর্মকর্তারা এই আসরের দর্শক। শিবগঞ্জ উপজেলা সদরে ইটভাটাসংলগ্ন স্থানে গোবিন্দগঞ্জের জাহাঙ্গীর ও জয়পুরহাটের মজফল প্রায়ই আসর বসায়। এটি থানা ও সার্কেল অফিসসংলগ্ন হলেও পুলিশ কিছু বলে না। বুড়িগঞ্জ ইউনিয়নের বেলভুজা গ্রামের খাড়িয়ার ভেতরে জামুরহাট বন্দরের প্রভাবশালী আব্দুল মতিন আসর বসায়। পিরব ইউনিয়নের বদির হাজির চাতালের উত্তর পাশে বটগাছের কাছে ও পিরব বন্দরে একটি দলীয় কার্যালয়ের পেছনে চলে আসর। এ ছাড়া ভাটরা গ্রামের ফুতিনের মুদি দোকানের সামনে প্রতিদিন সন্ধ্যা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত চলে আসর। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক আয়োজক বলে, ‘আসর বসলেই ওসি ও এএসপির সম্মানী পৌঁছে যায়। এ কারণে আমরা নিরাপদে থাকি। ’
এ বিষয়ে শিবগঞ্জ-সোনাতলা সার্কেলের এসএসপি মশিউর রহমান মণ্ডল বলেন, ‘খবর পেলে আমি অভিযান চালাই। কারণ সব অফিসারের ওপর আস্থা নেই। জুয়া বন্ধে সব সময় তৎপর রয়েছি। ’
আদমদীঘি ও নন্দীগ্রাম উপজেলার সীমানাসংলগ্ন চাঁপাপুরে দিনদুপুরে শামিয়ানা টানিয়ে চলে আসর। চাঁপাপুর বাজারে ঢোকার আগে একটি ইটভাটার পাশে নাগর নদের তীরে সপ্তাহে চার দিন বসানো হয় এই আসর। ফরঘুটি নামক এই লোভনীয় জুয়া খেলতে স্থানীয় ছাড়াও বগুড়া, নওগাঁ ও জয়পুরহাটের বিভিন্ন উপজেলা থেকে জুয়াড়িরা সমবেত হয়। চাঁপাপুরের ভোলা, শ্যামচন্দ্র ও জাবেদ আলী, নতুন মিয়াসহ ১৪ জুয়াড়ি এই আসর বসায়। প্রতিদিন এই আসর থেকে সংশ্লিষ্ট থানা ও সার্কেল কর্মকর্তা ঘুষ পান বলে নিশ্চিত করেছে পরিচালনাকারী একাধিক ব্যক্তি।
আদমদীঘি-দুপচাঁচিয়া সার্কেলের এএসপি আলমগীর রহমান বলেন, ‘আমরা অভিযান করি, মামলা দিই; কিন্তু জুয়া বন্ধ করতে পারছি না। এদের রক্তের সঙ্গে জুয়া মিশে আছে। তবে পুলিশ আসর থেকে কোনো চাঁদা নেয় না। ’
বগুড়া জেলা পুলিশের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বলেন, ‘আমি আদমদীঘির এএসপিকে নির্দেশ দিয়েছি জুয়ার আসর বন্ধ করতে। কিন্তু তিনি সেই নির্দেশ মানেননি। আসামিদের গ্রেপ্তার করেননি। ’
অনুসন্ধানে জানা গেছে, দুপচাঁচিয়ার ধাপের হাটে প্রতি বৃহস্পতি ও রবিবার আসর বসে। জুয়াড়ু আনিছার এটি চালায়। আসর বসলেই পুলিশের ভাগ থানায় পৌঁছে যায়। একইভাবে আরো একটি আসর বসে দুপচাঁচিয়া সেতুর নিচে নাগর নদের ধারে বাগানের ভেতরে। আনিছার ও আজিমের নিয়ন্ত্রণে এই আসরের ভাগও যথাসময়ে পুলিশের কাছে পৌঁছে যায়।
গাবতলী উপজেলার সোনারায় ইউনিয়নে অবাধে চলে জুয়ার আসর। তিন বছর ধরে কাজিপাড়ায় তাঁবু ও প্যান্ডেল টানিয়ে আসর বসে। ইউনিয়ন পরিষদের দুই সদস্য এই মেলার আয়োজক। তবে থানার পুলিশসহ অন্যদের ম্যানেজ করাসহ নির্বিঘ্নে আসর চালানোর দায়িত্বে রয়েছে নান্নু, মিজু ও কালু। প্রতি রাতের আসরের জন্য গাবতলী থানা ও সার্কেল কর্মকর্তা পেয়ে থাকেন ৩০ হাজার টাকা।
একইভাবে সোনাতলার চরখাবুলিয়ায় আসর বসে। পুলিশের বাধার মুখে এখন বসছে সারিয়াকান্দির চরে। লুত্ফর এই আসরের হোতা। থানার পুলিশ তাদের বাধা দেয়নি।
গাবতলী-সারিয়াকান্দি সার্কেলের এএসপি ফজল-ই-খুদা বলেন, ‘শুনেছি আসর বসছে। দুর্গম এলাকা হওয়ায় যাওয়া হয়নি। আর গাবতলীতে বড় আসর এখন বসছে না। ছোটখাটো আসর রোধ করা সম্ভব হয় না। ’
নন্দীগ্রাম উপজেলার সিধইল সুখানগাড়ী, রনবাঘা উচ্চ বিদ্যালয়ের পেছনে পুকুরপাড়ে দীর্ঘদিন ধরে আসর চালাচ্ছে প্রভাবশালীরা। এতে অংশ নিচ্ছে স্থানীয় কিছু জনপ্রতিনিধি ও বাইরে থেকে আসা পেশাদার জুয়াড়িরা। কিছুদিন বন্ধ থাকলেও আবার পুলিশের সবুজ সংকেতে চলে আসর। এ বিষয়ে কাহালু-নন্দীগ্রাম সার্কেলের এএসপি আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমরা সতর্ক রয়েছি। জুয়ার আসরের তথ্য পেলে অভিযান চালানো হচ্ছে। তবে অনেক সময় চুরি করে আসর বসায় অনেকে। ’
শেরপুর শহরতলির খন্দকার টোলা দক্ষিণ পাড়ায় আবুল কালামের বাড়িতে দিনে-রাতে বিরতিহীনভাবে আসর বসে। শাহবন্দেগী ইউনিয়নে আবুল কালামের বাড়িতে জুয়াড়ু লিটনের নেতৃত্বে আসর চলে। পৌর শহরের খন্দকার টোলা মাজারের পাশে কিলিক মোড় পলেস্টার পাড়ায় চলে আসর। শাহবন্দেগী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আল আমীন বলেন, ‘কিলিক মোড়ে রাত-দিন জুয়া খেলা চলে। ’
শেরপুর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) বুলবুল আহম্মেদ বলেন, ‘ইতিপূর্বে খন্দকার টোলা এলাকায় অত্যন্ত গোপনে একটি জুয়ার বোর্ড বসানো হলেও তা ভেঙে দেওয়া হয়েছে। নতুন করে বোর্ড বসে থাকলে তাও ভেঙে দেওয়া হবে। ’
এদিকে এক জুয়াড়ি বলেন, ‘বোর্ডে প্রতি রাতে লাখ লাখ টাকার জুয়া খেলা হয়। আসর বসলেই পুলিশ মোটা
টাকা চাঁদা পায়। এ কারণে বিরক্ত করে না। আর কখনো বাধ্য হয়ে অভিযান চালালে আগে থেকে সংবাদ দিয়ে দেয়। ’
কালের খবর ‘র অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, শাজাহানপুর উপজেলার কমপক্ষে চারটি পয়েন্টে বিভিন্ন সময়ে জুয়ার আসর চললেও উপজেলার আমরুল ইউনিয়নের আসর চলছে দীর্ঘদিন থেকে। বুঁড়ির ভিটায় শামিয়ানা টানিয়ে আসার চালানো হচ্ছে। একই ইউনিয়নের বেড়বাড়িতে দিনের বেলায় জুয়াড়ু হিটলু আসর বসায়। আসর চালানোর আগে সে থানায় গিয়ে কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করে আসে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় থানা পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, প্রভাবশালী দলের স্থানীয় কয়েকজন নেতার মদদে জুয়ার আসর চলছে। এই আসরের একটি বড় অংশ শাজাহানপুর থানার পুলিশের কাছে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। শাজাহানপুর থানার পরিদর্শক জিয়া লতিফুল ইসলাম বলেন, ‘আমার এলাকায় কোথাও কোনো আসর বসে না। ’
ধুনট উপজেলার বেড়েরবাড়ীর শিড়ি ঘরে বিশেষ ব্যবস্থায় সারা রাত ধরে চলে জুয়া। স্থানীয় থানার পুলিশের সঙ্গে সাপ্তাহিক ও মাসিক চুক্তিতে এটা চলে। জানতে চাইলে ধুনট থানার পরিদর্শক (তদন্ত) ফারুকুল ইসলাম বলেন, ‘সব ধরনের জুয়া বন্ধ করা হয়েছে। ’
এদিকে বগুড়া সদর থানার অন্তর্ভুক্ত বারপুরে বেশ কয়েকটি পয়েন্টে জুয়ার আসর বসছে। প্রতিদিন বিকেলে বসে এই আসর। বারপুর দক্ষিণপাড়ার সাহেব আলীর ভিটা, রব্বানীর মেশিন ঘরের পেছনে, পাঁচবাড়িয়া মোড়ের কাছে গঙ্গার বাচক্যা (গঙ্গা ভিটা), সদুপাড়া সেতুসংলগ্ন গড়ের ওপর, লালীপাড়া সেতুর কাছে, এসওএস স্কুলের উত্তর পাশে প্রাচীরসংলগ্ন নিচু জায়গায়, হাচেন পাগলার মাজারসংলগ্ন তালতলা ও ঘোলাগাড়ী ঈদগাহসংলগ্ন পতিত জমি হচ্ছে জুয়া খেলার অন্যতম স্থান। সদর থানার পরিদর্শক এমদাদ হোসেন বলেন, ‘জুয়া চলছে না। আমরা কোনো জুয়া চলতে দেব না। চুরি করে চালালেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ’
এর আগে জুয়া, হাউজি, লটারি, অশ্লীল নৃত্যসহ মাদকের আসর অবিলম্বে বন্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের দাবিতে অবরোধ কর্মসূচি পালন করেছে জেলা যুবলীগ। জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম ডাবলু ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘পুলিশের সদিচ্ছা থাকলে সমাজের এই অবক্ষয় বন্ধ করা সম্ভব। কয়েকজন পুলিশ সদস্যের কারণে পুরো ইউনিট প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে না। ’
বগুড়ার এসপি আলী আশরাফ ভূইয়া বলেন, ‘আমি নতুন এসেছি। চেষ্টা করছি সব কিছু শুদ্ধ করার। কোনো সংবাদ পেলে আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নেব। ’
.………….দৈনিক কালের খবর